‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’—এই নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করতে ১০ বছর আগে অ্যাডহক ভিত্তিতে দুই দফায় ৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসককে (সহকারী সার্জন) নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। এরপর গড়িয়েছে অনেক সময়, কিন্তু পরিবর্তন আসেনি এসব চিকিৎসকের ভাগ্যে। এই চিকিৎসকেরা ২০১০ সালে যে বেতনে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেই স্কেলে বেতন পাচ্ছেন এখনো।
এই দীর্ঘ সময়ে তাঁদের চাকরি ক্যাডারভুক্ত করা হয়নি, হয়নি পদোন্নতিও। হতাশ হয়ে কেউ কেউ চলে গেছেন অন্য পেশায়।
এসব অনেক দিনের সমস্যা। আমরা এটা দূর করার চেষ্টা করছি। সমাধান হবে। তবে একটু সময় প্রয়োজন
মো. আবদুল মান্নান , স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব
এই চিকিৎসকদের কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে একই পদে থাকায় তাঁরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। চাকরির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ হওয়ার পরও বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকেরা পদোন্নতি পেয়ে তাঁদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন জানিয়েছেন, তাঁরা এফসিপিএস, এমডি, এমএস, এফআরসিএসের মতো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও কর্মক্ষেত্রে এগোতে পারেননি।
৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে এখন কর্মরত আছেন ১ হাজার ৯৮৬ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অ্যাডহক কর্মকর্তাদের ক্যাডারভুক্ত করার বিষয়ে একটি প্রস্তাব গত সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আর কোনো বাধা থাকবে না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অনেক দিনের সমস্যা। আমরা এটা দূর করার চেষ্টা করছি। সমাধান হবে। তবে একটু সময় প্রয়োজন।’
নিয়োগ পেয়েছিলেন ৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক। এখন চাকরিতে আছেন ১ হাজার ৯৮৬ জন।
প্রেক্ষাপট
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন পর্যায়ের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক–সংকট ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক ২০০৯ সালের ১৩ এপ্রিলের এক সভায় জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসকের পদ শূন্য। এত বিপুলসংখ্যক পদ খালি থাকায় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। সে সময় জনপ্রতিনিধিরাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান। অনেকেই সংসদ অধিবেশনে নতুন চিকিৎসক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৮ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এবং একই বছরের ২৮ জুন তৎকালীন জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কাছে আধা সরকারিপত্র পাঠান। সেখানে তিনি চিকিৎসক–সংকটের কথা উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ৪ হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক নিয়োগের সুপারিশ করেন। কিন্তু সরকারি কর্ম কমিশন বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারের সহকারী সার্জন নিয়োগের বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২০১০ ও ২০১১ সালে ওই সংখ্যক চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হয়।
হতাশা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়োগ দেওয়ার পর এসব চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছিল নিজ জেলা কিংবা আশপাশের উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এসব চিকিৎসকের ভাষ্য, ২০১০-১১ সালে তাঁরা মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু তাঁদের ‘ত্যাগের’ মূল্যায়ন করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাঁদের অনেকেই ‘পড়াশোনাসহ নানা কারণে’ ঢাকায় চলে আসেন।
অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া অন্তত ৫০ জন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। চাকরিবিধি এবং পে স্কেল অনুযায়ী তাঁদের সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হয়নি।
চিকিৎসকেরা জানান, তাঁদের মধ্যে অন্তত এক হাজার চিকিৎসক উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। প্রায় ২০ জন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছেন। ৭০ জন সাফল্যের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। গত ৩১ জুন তাঁদের নিয়োগের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু চাকরি নিয়মিত হলেও ক্যাডারভুক্ত না হওয়ায় উল্লেখযোগ্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। তাঁদের পরে যোগ দেওয়া ৩৩তম বিসিএসের চিকিৎসকেরা ষষ্ঠ গ্রেড পেয়েছেন। আর তাঁরা আছেন নবম গ্রেডেই। অনেকের বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
চিকিৎসকদের ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রী অ্যাডহক চিকিৎসকদের ক্যাডারভুক্ত করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দেন। কমিটিকে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁরা এখনো কোনো অগ্রগতি দেখছেন না।
আমাদের অনেকেই ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আমাদের ভারমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার
মোহাম্মদ সায়েমুল হুদা, সাভারের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের একজন জাতীয় পুষ্টিসেবার উপব্যবস্থাপক নন্দলাল সূত্রধর প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকার পরও তাঁদের স্থায়ী না করা ও পদোন্নতি না দেওয়া দুঃখজনক। সাভারের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সায়েমুল হুদা বলেন, ‘আমাদের অনেকেই ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আমাদের ভারমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের ক্যাডারভুক্ত ও পদোন্নতির জন্য অনেক দিন ধরে কাজ করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ প্রায় ১০ বছর। ক্যাডারভুক্ত না হওয়ায় তাঁরা সবাই প্রারম্ভিক স্কেলে বেতন তুলছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁরা কোনো পদোন্নতি পাননি।
শারমিন আক্তার জাহান জানান, ক্যাডার–বহির্ভূত অস্থায়ী কর্মকর্তাদের ক্যাডারভুক্ত করার বিষয়ে একটি প্রস্তাব গত সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আর বাধা থাকবে না।
একজন চিকিৎসকের ১০ বছর পদোন্নতি না হলে তাঁর কি চাকরিতে আগ্রহ থাকে? স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে আমরা বারবার অনুরোধ করেছি সমস্যাটি সমাধান করতে
মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী , বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব
‘বারবার অনুরোধ করেছি’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকারই তাঁদের নিয়োগ দিয়েছিল। তাঁরা তো জোর করে চাকরি নেননি। সে সময় তাঁরা মাঠপর্যায়ে যে সেবা দিয়েছেন, তা সবারই জানা। তখন বলা হয়েছিল, তাঁদের ক্যাডারভুক্ত করা হবে। আর পদোন্নতি তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে হওয়ার কথা। এখন তাহলে কেন তাঁদের পদোন্নতি আটকে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসকের ১০ বছর পদোন্নতি না হলে তাঁর কি চাকরিতে আগ্রহ থাকে? স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে আমরা বারবার অনুরোধ করেছি সমস্যাটি সমাধান করতে।’